বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় : আমাদের কালের কথা

        প্রয়াত মাষ্টার রিয়াজ উদ্দীন
.
১৯৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমি চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি । তখন বিদ্যালয়ের অবস্থা বড়ই করুন । পাঁচ জন শিক্ষকের স্থলে আমিসহ মাত্র তিন জন শিক্ষক কর্মরত । তাও দু-জন নন মেট্রিক এবং অন্যজন অতি বৃদ্ধ । এ পরিস্থিতিতে ভাল ভাবে শিক্ষা দান সম্ভব ছিল না বিধায় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শিক্ষক সংখ্যা বাড়াবার অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। পরে নিরুপায় হয়ে তখনকার ম্যানেজিং কমিটির সদস্য জনাব কুতুব উদ্দীন আহমদ, মক্রম আলী, সিরাজ উদ্দীন, হাজী আব্দুল মনাফ, আরব আলী, জিয়া উদ্দীন, ও জনাব সোনাওর আলী মহোদয়সহ এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভা আয়োজন করি । সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্কুলের শিক্ষার মান্নোয়নের জন্য অত্র এলাকার তিনজন শিক্ষানুরাগী ( তখনকার কলেজ ছাত্র) ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও ছাদিক আহমদকে অবৈতনিক ভাবে স্কুলে শিক্ষাদানের আহবান জানাই । তারাও আমাদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বিষয়টিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করে শিক্ষাদানে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্কুলের সার্বিক উন্নতি ঘটে যার ফলে স্কুলের দু জন ছাত্রী মনোয়ারা বেগম ও আফিয়া বেগম পর পর দু'বছর সরকারী বৃত্তি লাভ করে। এমন কি সেই সময় রমজান মাসেও তারা, তৃতীয় শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী দেরকে নিয়ে বিশেষ কোচিং এর ব্যবস্থা করেন, যা এলাকায় উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । তখন অভিভাবকগন তাদের এহেন উদ্যোগে খুশি হয়ে ইফতারীর জন্য যে সম্মানী দিয়ে ছিলেন, সেই সম্মানী দিয়ে তারা স্কুলের জন্য একটি হাতল চেয়ার ও স্কুল ঘরের ভিতরের ছাদ নির্মাণ করে দেন । তাদের এ সকল কার্যক্রম সে সময় আমাকে দারুন ভাবে প্রভাবিত করে । এরা তখন কীভাবে এলাকার উন্নয়ন হয়, কীভাবে এলাকাবাসি দেরকে একত্রিত করে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যায়, এ নিয়ে আমার সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। তখন আমাদের সমমনা আরেকজন বন্ধু জোটেন । তিনি হলেন লন্ডন প্রবাসী জনাব আব্দুল খালিক। ১৯৮৩ সালে আমরা ইউনিয়ন ভিত্তিক বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করি । দুই দিন ব্যাপী এই প্রতিযোগিতার সমাপনী দিনের চা-চক্রে এলাকাবাসী অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে আমরা পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে এলাকায় একটি পোষ্ট অফিস ও একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করি । সবাই এতে একমত পোষণ করে আমাকে একটি সভা আহবানের পরামর্শ দেন। এক সময় পোষ্ট অফিস স্থাপনের কাজ বেশ এগিয়ে যায় কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। ১৯৮৫ সালে আমরা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয়ে একটি সভা আহবান করি । সভায় এলাবাসি প্রাইমারী স্কুলের সম্মুখস্থ জায়গাটি স্কুলের জন্য পছন্দ করেন। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও জমির মালিককে জমি দানে রাজী করানো সম্ভব হয়নি। এমনকি হাজী আব্দুল মনাফ উল্লিখিত জমির পরিবর্তে অন্য জমি (অন্য যে জায়গায় তার জমি আছে সেখান থেকে) দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও আমাদের কাঙক্ষিত জমিটি পাওয়া যায়নি। পরে কালিদাস পাড়া, রায়গড়, ইত্যাদি স্থানে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছু সভা আহবান করা হয়। এক সময় 'রায়গড় দ্বিতীয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের' পাশে একটি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু সভার শেষ বক্তা ফারুক আহমদের যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত তাও হয়নি।
১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি প্রবাসী আব্দুল খালিক, ফারুক আহমদ, হুসেন আহমদ ও ছাদিক আহমদ এই পাঁচজন মিলে একটি সভা আহবান করে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেই যে, যা হবার হবে ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আমরা চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী চালু করবো। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন প্রাইমারী স্কুলের রেজাল্ট ঘোষণার সাথে সাথে একটি সভা আয়োজন করি। এতে ২৮ জন অভিভাবক ও এলাকাবাসি উপস্থিত ছিলেন। সভায় কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ ক্রমে প্রাইমারী স্কুলের নির্মানাধীন আইডিএ কক্ষ-সংলগ্ন স্থানে কাঁচাঘর তৈরী করে এবং সাময়িকভাবে অফিস কক্ষ ও আইডিএ কক্ষে ক্লাস চালু করা যায় কি না এ বিষয়ে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সাথে সাথে ১৯৮৭ এর ১ জানুয়ারি থেকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির জন্য অভিভাবক দের সাথে যোগাযোগ ও ক্লাস চালু করার জন্য ফারুক আহমদ, হুসেন আহমদ ও ছাদিক আহমদ প্রানপণ প্রচেষ্টা চালান। এ সময় আমাদের সহযোগি ও পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন লন্ডন প্রবাসী আব্দুল খালিক, আব্দুল ওদুদ, মাখন মিয়া, জিয়া উদ্দীন, ইসমাইল আলী, হাজী আব্দুল মনাফ, মাওলানা সামসুদ্দীনসহ আরও অনেকে । এছাড়া সভাগুলোকে সাফল্যমন্ডিত করে স্কুলে ছাত্রছাত্রী দেরকে ভর্তি হতে অনুপ্রাণিত করা অর্থা যেখানে যা প্রয়োজন তা করতে বিশেষ ভাবে ভুমিকা পালন করেন আব্দুল হেকিম, শওকত আলী, মাশুক উদ্দীন, আবুল কালাম ও চুনু মিয়া (দরজী) সহ আরও অনেকে। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ জানুয়ারী আমি প্রাইমারী স্কুলে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী খোলার অনুমতি লাভ করি এবং আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে থাকি ।এই সময় প্রবাসী আব্দুল খালিক (লন্ডনী) একখন্ড ভূমি দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে আমাদের এই উদ্যোগ আরও বেগবান হয়। তখন একটি কাঁচাঘর নির্মানের জন্য হুসেন আহমদ দুই বান্দ টিন, মাখন মিয়া এক বান্দ টিন ও তজম্মুল আলী (তুতা মিয়া) দুই বান্দ টিন দান করেন। এছাড়া আব্দুল ওদুদ স্কুলের জন্য খাতাপত্র ও ব্যানারের কাপড় এবং হুসেন আহমদ ব্যানারটি লিখিয়ে দেবার দায়িত্ব নেন। তখন স্কুলের নাম (দেওয়া হয় ) ছিল 'রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়'। সে সময়কার সভাগুলো হাজী আব্দুল মনাফ, আব্দুল খালিক ও হাজী নিসার আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠার ধ্বনি জোরেসুরে এলাকাময় ছড়িয়ে দেন উক্ত ব্যক্তিবর্গের সাথে আলা উদ্দীন, মাওলানা শওকত আলী, জয়াইদ আলী,হাজী ময়না মিয়া ও আব্দুল খালিক প্রমুখ। বলা যায়, তখন গোলাপগঞ্জ বাজারে অবস্থিত আব্দুল ওদুদের টেইলারিং শপটি এতদসংক্রান্ত একটি সভা কক্ষে পরিণত হয়েছিল। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রানপণ প্রচেষ্টা দেখে একদিন প্রবাসী আব্দুল খালিক, ফারুক আহমদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, " তুমি একজন সত্যিকারের সংগঠক। সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের দ্বারা যে সমাজের উন্নয়ন হয় তা-ই প্রমাণীত হতে চলেছে। এজন্য তোমাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ। আজ থেকে তুমি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রথম প্রধান শিক্ষক আর হুসেন আহমদকে আমরা বানাবো স্কুলের প্রথম সভাপতি। "তখন ফারুক আহমদ, হুসেন আহমদ, ছাদিক আহমদ, আছমান উদ্দীন ও বদর উদ্দীন আহমদের (টুনুমিয়া) সাথে ধর্ম শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মাওলানা আব্দুল লতীফ এবং খন্ডকালীন হেলাল উদ্দীন আহমদ। সার্বক্ষণিক শিক্ষকরা প্রায় সকলেই ছিলেন অল্প বয়স্ক। তাই আমরা এম.সি.একাডেমির প্রাক্তন শিক্ষক আব্দুল মুকিতকে স্কুলে নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগী হই। আমি তাকে আনার দায়িত্বটা চাপিয়ে দেই ফারুক আহমদের উপর। সম্ভবত ১৯৮৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ফারুক আহমদ আব্দুল মুকিতকে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করতে রাজী করান। তখন ফারুক আহমদ আমাদের কাছে প্রস্তাব করেন যে আব্দুল মুকিত সাহেব তার শিক্ষক । তাই স্বেচ্ছায় তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দ্বায়িত্বটি জনাব আব্দুল মুকিত সাহেবের নিকট হস্তান্তর করতে চান। এর পর থেকেই আব্দুল মুকিত সাহেব ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেন। তবে রণকেলী গোলাপ কুঁড়ি শিশু বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাদান শেষে স্কুলে আসার পূর্ব পর্যন্ত ফারুক আহমদ সুষ্টভাবে স্কুল পরিচালনা করতেন এবং এতে তাকে আমি সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। প্রবাসী আব্দুল খালিক সাহেবের জমি পাওয়ার পর জয়াইদ আলী, আব্দুল খালিক, আব্দুল মজিদ (ময়না মিয়া) সালেহ আহমদ চৌধুরী, হাজী নিসার আলীকে নিয়ে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ ইংরেজী তারিখে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হয়। স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন উপজেলা চেয়্যারম্যান জনাব ফজলুল হক (তানু মিয়া) এবং অনুষ্টান শেষে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্কুলের ক্লাস উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও এম. সি. একাডেমির প্রধান শিক্ষক জনাব এম. করিম চৌধুরী। সম্ভবত ওই দিন অথবা এর দু'একদিন পরে গোলাপগঞ্জে জনাব আব্দুল ওদুদ-এর টেইলারিং শপে জনাব খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া) নতুন স্থানে স্কুল গৃহটি বাঁশবেত দিয়ে তৈরীর পরিবর্তে পাকা করে নির্মানের প্রস্তাব রাখেন এবং এতে প্রয়োজনীয় সিমেন্ট দানসহ সার্বিকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দানের ফলে এলাকাবাসীর মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করে। পরবর্তীকালে তার এই দূরদর্শী চিন্তা ধারার জন্য তাকে স্কুল নির্মান কমিটির সভাপতি নির্বাচন করে নতুন স্কুল গৃহটি নির্মিত হয়। এ নির্মান কাজে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন শিল্পপতি তজম্মুল আলী (তুতা মিয়া) সহ এলাকার অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। এখানে উল্লেখ্য যে, স্কুলের পাকাঘর নির্মানের আগে ৭ম শ্রেণীর জন্য চৌঘরী-গোয়াসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আইডিএ কক্ষের পশ্চিম পাশে একটি কাঁচাঘর জিয়া উদ্দীনের সহ যোগিতায় (এরা এলাকা থেকে বাশ সংগ্রহ করেন ) তৈরী করা হয়। এছাড়াও ১৯৮৭-এর ২ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুলটি নতুন স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্কুল পরিচালনার জন্য ডেক্স-বেঞ্চ-চেয়ার-টেবিল-ব্লাকবোর্ড-ডাস্টার এবং প্রথমে আমার অফিস কক্ষ এবং পরে আইডিএ কক্ষ-সহ স্কুলের যাবতীয় দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে দিয়েছি।
বলা বাহুল্য, এই ছোট স্মতিচারণমুলক লেখায় এলাকার সকলের অবদানের কথা স্মৃতি থেকে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কথা হয়তো ভুল বশত: এ লেখায় আসেনি। তবে সর্বশেষে আমি এ কথা বলবো যে, এ বিদ্যালয়টিকে স্বার্থক রুপায়নে আমাদের সকলের চাইতে তুলনামুলক ভাবে বেশি কৃতিত্বে দাবীদার খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), শিল্পপতি তজম্মুল আলী(তুতা মিয়া), মাখন মিয়া, হুসেন আহমদ ও আলাউদ্দীন প্রমুখ।_____রিয়াজ উদ্দীন : অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রানাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। (রানাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় : স্মারক ২০০৬ থেকে সংগৃহীত)। (সংগ্রহে: হাফিজুল ইসলাম লস্কর)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন