বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়: ইতিহীন স্মৃতিকথা

ফারুক আহমদ
.
আদিকাল থেকে স্মৃতিই ছিল শিল্পের উৎস। সুখ বা দু:খানুভূতির অভিঘাতই ছিল এর প্রকাশ। ইংরেজীতে একটি আছে, Experience is knowledge অর্থাৎ অভিজ্ঞতাই জ্ঞান। আমাদের এই অভিজ্ঞতাই বলছে, আগে অনুভব, পরে অভিব্যক্তি বা Evolution। এই দুইয়ের মধ্যবর্তা কোনও মুহূর্ত হতে পারে অতি সামান্য অথবা সুবিশাল-তারই নাম হতে পারে স্মৃতি, যা অনুভবকে ধারণ করে। আর এই অনুভবকে ধারণ করা স্মৃতিকথা লেখতে গেলে সমস্যা অনেক। কারণ স্মৃতির সাথে 'আমি' 'আমার' অথবা এই জাতীয় 'অহং' বা 'আমিত্ববোধ' লেখকের অজান্তেই আপনা-আপনি উড়ে এসে জুড়ে বসে। এছাড়া স্মৃতি প্রায়ই মানুষের সাথে প্রতারণা করে। ফলে সন-তারিখ, ঘটনার ধারাবাহিকতা, মানুষের নাম ইত্যাদি অনেক কিছুই সঠিকভাবে তোলে ধরা সম্ভব হয় না। বলা বাহুল্য, রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়টি কখন, কিভাবে, কার কার উদ্যোগ ও সাহায্য-সহযোগিতায় এবং কোনও পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সংক্রান্ত প্রথম থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত উল্লেখ যোগ্য সভাগুলোর কার্যবিবরণী ও সদস্যদের উপস্থিতির খতিয়ানসহ প্রয়োজনীয় দলিলাদি আমার সংগ্রহে ছিল। কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে হঠাৎ করে মাত্র এক সাপ্তাহের ওয়ার্ক-পারমিট নিয়ে ১৯৮৯-এর ২৮ ডিসেম্বর আমাকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিতে হয়। ফলে শুধু স্কুল-সংক্রান্ত মূল্যবান কাগজপত্রই নয় বরং সেই সাথে আমার সব ক'টি ডায়েরী যেখানে যেভাবে ছিল সেভাবেই রেখে যাই। তারপর সুরমা নদীর জলের মতো টেমস নদীর তীরে প্রায় এক দশকেরও বেশী সময় কাটিয়ে আজ দেশে এসে যখন এই লেখাটি লিখতে বসেছি (২০০০-এর ২০ফেব্রুয়ারি), তখন স্কুলের বয়স প্রায় পনেরো বছর। এই পনেরো বছরে স্কুলটি প্রায় সকল দিক দিয়েই পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে, খ্যাতিমানদের আগমন ও প্রস্থানের কলকাকলিতে মুখরিত হয়েছে এর আঙ্গিনা। কিন্তু উল্লিখিত পুরো পনেরো বছরের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের সাক্ষী আমি হতে পারিনি। তবে সৌভাগ্যের কথা যে স্কুল প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের মূল্যবান কাগজপত্রগুলো ফিরে এসে অক্ষত অবস্থায় পেয়েছি। তবুও পাঠকদের কাছে আগে-ভাগে বলে নিচ্ছি যে, সংগত কারনেই আমার এই আটপৌরে স্মৃতিচারণটি একটি সীমিত গন্ডির মাধ্যে (১৯৮৭-১৯৮৯) সীমাবদ্ধ থাকলেও সচেতন পাঠকের কাছে অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হতে পারে, স্কুল সম্পর্কিত এমন কিছু তথ্য এলাকা বাসির অনুরোধে আমাকে যোগ করতে হয়েছে। সেই সাথে আমাদের গোলাপ গঞ্জ এলাকার আরও দু-একটি স্কুলের কথাও প্রসঙ্গক্রমে এ স্মৃতিচারণে আসবে। আমার জানামতে, রাণাপিং পরগণার কালিদাস পাড়ায় ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত রাণাপিং জুনিওর হাই স্কুলটি সম্ভবত ১৯৭২ সালের দিকে বন্ধ হয়ে যাবার পরে আবার আমরা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হই ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে। তাও আমাকে নিয়ে এম.সি একাডেমিতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি হলো, স্কুলের নিয়মানুযায়ি সেই বছর দশম শ্রেণী থেকে জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচন করা হবে। সৌভাগ্যক্রমে ঐ বছর ছাত্রছাত্রীগণ তাদের মনোনীত একমাত্র প্রার্থী হিসেবে আমাকে নির্বাচন করবে বলে স্থির করে। অর্থাৎ সে বছর আমার আর কোনও প্রতিদ্বন্ধী ছিলেন না। তবুও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নির্বাচনের আগের দিন আমার সহপাঠী হোসেন আহমদ (চৌঘরী), আবুল বাসার মিশু (দাড়িপাতন) আহমদ হোসেন চৌধুরী (রণকেলী), তানহার আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), কেরামত আলী (ফুলবাড়ী), রুহেল আহমদ (দাড়িপাতন), বদর উদ্দীন আহমদ হেলাল (হাজিপুর), প্রমুখ শুভাকাঙ্খীরা স্কুলে একটি সভা আহবান করে এবং এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের চুড়ান্ত মতামত জানতে চাইলে, সকলে এক বাক্যে আমার পক্ষে রায় দেয়। সভায় আমি নিজেও বক্তৃতা করি। নির্বাচনের দিন আমাদের প্রধান শিক্ষক মহোদয় এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মতামত চাইলে তারা সবাই একসাথে উচ্চস্বরে আমার নামটি প্রস্তাব করে। তখন তিনি (প্রধান শিক্ষক) লম্বা একটি বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদেরকে বুঝিয়ে দেন যে, স্কুলে তাঁর মতামতের বিরুদ্ধে কোনও দিন কারো কোনও মতামত চলেনি। ভবিষ্যতেও চলবে না। এমনকি তার মতামতের বিরুদ্ধে স্কুলে জট পাকানো বা কোনও ধরণের রাজনীতির করারও কোনও সুযোগ নেই। যারা তা করতে যাবে, তাদেরকে তিনি কঠোর হস্থে দমন করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে তিনি আমার ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদেরকে বলেন যে, আমি দেখতে যেমন কম বয়স্ক, তেমনি বেশ খাটো। কোথাও টুর্ণামেন্ট বা এ ধরণের কিছু হলে এবং স্কুলের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল সেক্রেটারীকে কিছু বলার জন্য ডাক পড়লে, আমাকে কেউ উপরে তোলে ধরতে হবে। অথবা টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। সুতারাং এ বিষয়ে গাট্র-মোট্রা-বড়-সড় আহম্মক হলেও ক্ষতি নেই। কথাগুলো বলে তিনি তার আত্বীয়, আমার আরেক সহপাঠী, যে নিজেই আমাকে জি. এস নির্বাচিত করার জন্য ক্যাম্পেইন করেছে, তার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে জানতে চান, জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে সে কেমন হবে? তখন দু-তিনজন ছাত্র 'ভাল হবে' বলায় তাকেই সেদিন জি. এস নির্বাচন করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রধান শিক্ষক মহোদয় সেদিন আমাকে আর কোনও পদেরও উপযুক্ত মনে করেননি। এই বিষয়টি আমি এবং আমার শুভাকাঙক্ষীদেরকে যেমন দারুন ভাবে আঘাত করেছিল, ঠিক তেমনি সাধারণ ছাত্রছাত্রীগনও সেদিন রীতিমত অবাক করে দিয়েছিল। ওই ঘটনার দিন বিকেলে আমি ও হোসেন আহমদ বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করি এবং প্রতিজ্ঞা করি ঘটনাটির সঠিক জবাব হিসেবে আমরা আমাদের এলাকায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্টা করবো। এবং সে লক্ষ্যে আমাদের এস এস সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই কাজ আরম্ভ করবো বলে সিন্ধান্ত নেই। আজ সেদিনের কথাটি যখন মনে পড়ে তখন ভাবি, ওই চিন্তাধারা ছেলে মানুষি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কেননা আমরা নিজেরাও তখন হাই স্কুলের আঙ্গিনা ডিঙ্গাতে পারিনি, অতচ পরিকল্পনা করছি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করবো! যে যাই হোক। পরীক্ষার পর আমরা যখন বাড়িতে অবসর দিন কাটাচ্ছি এবং চিন্তা-ভাবনা  করছি কীভাবে পরিকল্পনাটিকে বাস্তবে রুপদান করবো। ঠিক ওই সময় চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার দরুন এলাকাবাসীর পরামর্শ তৎকালীন। প্রাধান শিক্ষক জনাব আব্দুল জব্বার(বাঘা ইউনিয়নের, লালনগর গ্রাম নিবাসী) সাহেব আমাদেরকে বিদ্যালয়ে অবৈতনিকভাবে শিক্ষকতার অনুরোধ জানান। আমরাও সানন্দে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষকতায় যোগদান করি। আর তখনই বর্তমান হাই স্কুলের পার্শবর্তী এলাকায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হই। আর তখনই বর্তমান হাই স্কুলের পার্শবর্তী এলাকায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হই। কিন্তু এলাকার জনমত পক্ষে থাকা সত্ত্বেও বয়স, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্থানাভাব ইত্যাদি নানা কারণে খুব বেশি দুর অগ্রসর হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে এলাকায় হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার মূল সুরটি তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম বলেই মনে হয়। এই সময় লন্ডন-প্রবাসি জনাব আব্দুল খালিকও (গোয়াসপুর) দেশে এসে এলাকায় একটি সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার প্রতেষ্ঠা চালান। তাঁর এ প্রচেষ্ঠা দুরদর্শী হলেও প্রস্তাবটি তিনি সঠিকভাবে এলাকাবাসির কাছে উপস্থাপন করতে পারেননি। ফলে তা ব্যর্থ হয়। পরে তিনি তাঁর বাড়ির লোকজনকে নিয়ে আবারও প্রচেষ্টা চালান। তাদের কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, সবাই নিজ নিজ সম্পত্তি সমিতির নামে ওয়াকফ করে দিয়ে, প্রত্যেকে যার যার পেশাগত কাজ করবেন। যা আয় হবে তা এনে জমা দেবেন সমিতিতে। সমিতি প্রতিদিন মাথাপিছু হারে সদস্যদের পরিবারকে সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অর্থাৎ চাল-ডাল-তরি-তরকারী-কাপড়-চিকিৎসা-বাসস্থান, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সমানভাবে সরবরাহ ও তদারকি করবে। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আদলে সমবায় সমিতি। বাড়ির লোকেরা তাঁর এই উদ্যোগে কম্যুনিজমের গন্ধ পেলেন বিধায় কেউই তাঁর পক্ষে সায় দিলেন না। পরে তিনি উদ্যোগ নিলেন সমবায়ের মাধ্যমে এলাকায় একটি সাবান ফেক্টরী প্রতিষ্ঠার। তখন আমি এবং আমার বন্ধু হোসেন আহমদ তাঁর এই উদ্যোগে সহযোগি হিসেবে জড়িয়ে গেছি। কিন্তু শেয়ারের দাম নিয়ে তাঁর সাথে আমাদের মতভেদ দেখা দেয়। এবং আমাদের বিরোধীতার ফলে, তাঁর সেই উদ্যোগও বিফলে যায়। আর তখনই আমরা তাঁকে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় জন্য আমাদের দলে টানতে সক্ষম হই। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব ঘটনার কয়েক বছর পরে আব্দুল খালিক, এলাকার বিখ্যাত অলি হযরত শেখ মোহাম্মদ সাঈদ-এর নামানুসারে তাঁর পার্শবর্তী বাড়িগুলোর লোকজনদেরকে নিয়ে, শেখ সাঈদ জনকল্যান সমিতি' গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের শেষ ভাগে অর্থাৎ নভেম্বর/ডিসেম্বরের দিকে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন রিয়াজ উদ্দীন (গোয়াসপুর)। স্কুলের শিক্ষক সমস্যা তখনও বিরাজমান। মাত্র তিনজন শিক্ষক। রিয়াজ উদ্দীন, মাহমুদ হোসেন চৌধুরী(খলুমিয়া, গীর্দ্দ) ও সোনাওর আলী(চৌঘরী)। তখন আমরা এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে অবসর দিন কাটাচ্ছি। সে সময় আমাদের সাথে আরেকজন বন্ধু যোগ দিয়েছেন, তিনি হলেন মি.ছাদিক আহমদ(চৌঘরী)। ইত:পূর্বে প্রাইমারী স্কুলে অবৈতনিকভাবে শিক্ষকতা করার সুবাধে এলাকায় আমাদের একটা ছোটখাটো অবস্থান গড়ে ওঠেছে। ফলে স্কুল পরিচালনা পর্ষদের পরামর্শে তখন প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীন আমাদের তিনজনকে আগের মতো স্কুলে শিক্ষকতার অনুরোধ জানান। আমরাও এ সুজোগটির অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ আমাদের পরিকল্পনা ছিল, এলাকার সন্তান হিসেবে রিয়াজ উদ্দীনকে সামনে ধরে আবার হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমরা সেভাবে এগিয়েও যাই। ১৯৮২ সালের মধ্যভাগে, সম্ভবত জুন/জুলাই মাসে আব্দুল খালিক বিলাত থেকে এসে আমাদের এই প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করেন। কিন্তু স্থানাভাবে আমরা বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। (এখানে উল্লেখ্য যে, ইত:পূর্বে আমরা প্রাইমারী স্কুলের পাশে একটি পোস্ট অফিস স্থাপনের জন্য কয়েকশ টাকা চাঁদা তোলার পর, আমাদের মাঝে, অথাৎ আমি ও হোসেনের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির দরুন এবং স্থানাভাবে আমরা তা করতে ব্যর্থ হই। পরে আমাদের ব্যর্থতার সুযোগে মতিউর রহমান (ছত্তিশ), ইসমাইল আলী (তহিপুর), মাওলানা শওকত আলী (গোয়াসপুর), মাওলানা আব্দুল আজিজ(গোয়াসপুর), মোস্তফা কামাল(ছত্তিশ) ও আলা উদ্দীন(গোয়াসপুর) প্রমুখের ডাকে একাধিক সভা কালিদাস পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠত হয়। আমি ও আব্দুল খালিক সম্ভবত এক অথবা দু'টি সভাতে উপস্থিত ছিলাম। এখানে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ছত্তিশ নিবাসি মোস্তফা কামালের নগদ আশি হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি এবং তহিপুর এলাকায় ইসমাইল আলীর প্রয়োজনীয় ভূমি দানের আশ্বাস পাওয়ার পরও আমরা হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই। কারণ আমরা চেয়েছিলাম এলাকার সকল মানুষের সুবিধার্থে স্কুলটি এম সি একাডেমি ও ঢাকাউত্তর মোহাম্মদপুর হাই স্কুলের ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে(চন্দনভাগ গ্রামের জমসিদ মিয়ার পুল ও বর্তমান হাই স্কুলের কাছাকাছি কোথাও) প্রতিষ্ঠা করা হোক। অর্থাৎ হাই স্কুলটি যেন অধুনালুপ্ত ' রাণাপিং জুনিয়র হাই স্কুল,,-এর ভাগ্যবরণ না করে। কিন্তু আমরা সকলে একমত হতে পারিনি বিধায় ব্যর্থ হই। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারী মাস। আলা উদ্দীন(গোয়াসপুর), খন্দকার ফখর উদ্দীন, (ঘোগা) মরতুজ আলী, আজাদ উদ্দীন(রায়গড়) প্রমুখের উদ্যোগে রায়গড় দ্বিতীয় সরকারী প্রাইমারী স্কুলের পাশে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়। এতে মুখ্য ভুমিকা পালন করেন উল্লিখিত প্রাইমারী স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মর্তুজ আলী। এ মানুষটির দূরদর্শি সাংগঠনিক দক্ষতার ফলে রাণাপিং পরগণার প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামের মানুষের উপস্থিতিতে বাগিচার টিলা(এজমালী সম্পত্তি) থেকে এলাকাবাসীর দেয়া প্রয়োজনীয় ভূমি এবং আব্দুল মতলিবের(ঘোগা) নিজস্ব টাকায় টিনসেড দিয়ে স্কুল ঘর বানিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিকে সম্বল করে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য খোন্দকার ফখর উদ্দীনকে সভাপতি ও আলা উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করে পরগণার প্রত্যেকটি গ্রামের প্রতিনিধি নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে স্কুল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে এর তিনদিন পর থেকে ঘরের কাজ আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্কুল সম্পর্কিত উল্লিখিত সভা সম্পর্কে আমি জানতে পারি ঐদিন ভোরে আলা উদ্দীন সাহেবের স্ত্রী মিসেস কায়েমুন্নিসার কাছ থেকে। আলা উদ্দীন উল্লেখিত সভার অন্যতম আহবায়ক হলেও তাঁর স্ত্রী বাগিচার টিলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন না। ফলে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে এক প্রকার জোর করে সভাস্থরে পাঠান, কি হচ্ছে তা দেখে আসার জন্য। আমিও প্রায় শেষ পর্যায়ে সভাস্থলে পৌঁছি এবং আমার শিক্ষক স্বরস্বতি নিবাসী রফিক উদ্দীন আহমদ ও আলা উদ্দীন যৌথ প্রস্তাবে সভায় কথা বলার সুযোগ লাভ করি। আমি উল্লিখিত স্থানে স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলাম না। শুধু ঐ স্থানে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার ভাল-মন্দ দিকগুলো যাচাই করার জন্য সভার কাছে কিছু প্রস্তাব রেখেছিলাম মাত্র।

কিন্তু আমার প্রস্তাবগুলোকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তাদের দু-একজন দারুনভাবে ক্ষেপে যান। পরে সভাপতির হস্থক্ষেপে আমার বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে এবং সিংহভাগ আলোচক আমার বক্তব্যের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করায় ঐ দিন গৃহীত সিদ্ধান্তকে স্থগিত রেখে সভার কাজ শেষ হয়ে যায়। এর পরের দিন রিয়াজ উদ্দীন (গোয়াসপুর), জিয়া উদ্দীন (চৌঘরী), হোসেন আহমদ (চৌঘরী), মহরম আলী (গোয়াসপুর), মাওলানা সামসুদ্দীন (চৌঘরী), প্রমুখ চৌঘরী গোয়াসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে রায়গড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেয়া আমার বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং কীভাবে আরও বলিষ্ট ভূমিকা নিয়ে স্কুলটি উক্ত বিদ্যালয়ের পাশে প্রতিষ্ঠা করা যায় এ নিয়ে আলোচনা করেন। যেহেতু ভূমি আমাদের প্রধান সমস্যা। এবং যে ভূমিতে আমরা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তা আব্দুল খালিক লন্ডনী ও মঈন উদ্দীন (গোয়াসপুর ) সাহেবের। কিন্তু এই দুটি পরিবারই স্কুলে জমিদান কিংবা বিক্রি করতে রাজী নন। এর মধ্যে আব্দুল খালিক অপেক্ষাকৃত ধনী, আমাদের সমমনা এবং স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ সহযোগি। যদিও তিনি এর আগে কোনও সময়েই জমিদানে সম্মত হন নাই, তবুও শেষ ভরসা হিসেবে আব্দুল খালিক (লন্ডনী) দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে নীরব থাকার পাশাপাশি অন্য পক্ষকে জমি দানে রাজী করানো যায় কি না এ প্রচেষ্টা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৮৬ সালের ২১ ডিসেম্বর। গোলাপগঞ্জ গিয়ে, হোসেন আহমদের কাছে জানতে পারি আমাদের বন্দু ছাদিক আহমদ (চৌঘরী) সপ্তাহ খানেক হয় সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন। ঐদিন বিকালে আমরা দু-জন তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। এক সময় কথা প্রসঙ্গে ছাদিক আহমদ আমাদের বলেন যে, তিনি সৌদি আরব থাকতে একদিন স্বপ্নে দেখেছেন, চোঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলের পাশে একটি হাই স্কুল হয়েছে এবং সেখানে তিনি শিক্ষকতা করছেন। কথাটি বলে প্রশ্ন রাখেন, হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার কি হলো?আমি ও হোসেন আহমদ তাকে এ বিষয়ে অবহিত করি এবং আমরা যে আব্দুল খালিক সাহেবের দেশে আসার জন্য অপেক্ষা করছি সে কথাটিও বলি। তখনই হোসেন আহমদ আমাকে জানায় যে, খালিক সাহেবও দেশে এসেছেন। আমি মি। খালিকের সাথে দেখা করার প্রস্তাব করলে;পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য অর্থাৎ ইত:পূর্বে খালিক সাহেব ভূমিদানে রাজী না হওয়ায় সেদিন হোসেন আহমদ মি. খালিক সাহেবের সাথে দেখা করতে যেতে রাজী হয়নি। বরং আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় যে, খালিক সাহেবকে জমি দানে রাজী করাতে পারলে সে একাই স্কুল ঘরটি বানিয়ে দেবে। এই বলে সে ছাদিক আহমদকে নিয়ে সে তার বাড়ির দিকে চলে যায়। আমিও চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে হাজির হই খালিক সাহেবের বাড়িতে। সৌজন্যমূলক আলাপ-আলোচলার পর বিষয়টি উত্থাপন করি। কিন্তু তিনি কোনও ভাবেই তাঁর মূল্যবান জমিটি দান করতে রাজী নন এবং এতে তাঁর পারিবারিক সমস্যাও ছিল। ফলে অনেক অনুরোধের পর তাঁকে শুধু এলাকার স্বার্থে একটি সাজানো আশ্বাস দানের অনুরোধ জানাই যে, আগামীতে কোনও সভা আহবান করা হলে, সে সভায় তিনি যেন বলেন, আমরা স্কুল আরম্ভ করলে পরে তিনি জায়গা দেবেন। অর্থাৎ তাঁর কাছে আমার যুক্তি ছিল, স্কুলটা একবার চালু হয়ে গেলে, পরে অন্য যে কোনও স্থানে সরিয়ে নেয়া যাবে। এছাড়া রায়গড় এলাকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরও যখন স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পেরেছি, তখন তাঁর জমি ব্যবহার না করেও আমরা স্কুল করতে পারবো। প্রস্তাবটি তাঁর কাছে মোটামোটি গ্রহনযোগ্য হয়েছে বলেই মনে হলো। তিনি রাজি হলেন। সেই রাতে চকরিয়ারমুরায় এসে কথাটি মাওলানা শামসুদ্দীন ও চুনু মিয়া (দরজী, চৌঘরী), নোমান মিয়া (চৌঘরী)সহ আরও দু-একজনের সাথে আলাপ করি। পরের দিন সংবাদটি বিদ্যুতের মতো যেন চারিদিকে ছড়িয়ে যায় এবং এলাকায় দারুন উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। পরে ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ সালে চৌঘরী গোয়াসপুর প্রাইমারী স্কুলে আব্দুল খালিক, রিয়াজ উদ্দীন, ছাদিক আহমদ, হোসেন আহমদ ও আমি এই পাঁচজন, জমি সংক্রান্ত বিষয়টিকে আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি মতো মৌখিকভাবে রেখে প্রাইমারী স্কুলের পশ্চিম পাশের খালি জায়গায় টিনসেডের একটি ঘর বানিয়ে এবং আপাতত স্কুলের আইডিএ কক্ষে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী চালু করার জন্য ৩০ ডিসেম্বর দুপুর ১ঘটিকার সময় চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে একটি সভার আয়োজন করি। ৩০ তারিখ সভা আহবানের কারণ, দিনটি ছিল স্কুলের বার্ষিক ফলাফল প্রকাশের দিন। ফলে আমরা আশা করেছিলাম সভা আহবান করলে অভিভাবকগন আসবেন এবং সে সুযোগে আমরা আমাদের স্কুল প্রতিষ্ঠার কথাটিও সবাইকে জানাবো। ঐদিন সভায় সভাপতিত্ব করেন হাজী আব্দুল মনাফ (গোয়াসপুর)। ওই দিনের সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন : হাজি মো:ফয়াজ উদ্দীন চৌধুরী (গোয়াসপুর), আজির উদ্দীন(গোয়াসপুর), ইসমাইল আলী(চৌঘরী), মহরম আলী (গোয়াসপুর), মক্রম আলী (গোয়াসপুর), মইন উদ্দীন (গোয়াসপুর), রশিদ আহমদ (গোয়াসপুর), ইমাম উদ্দীন (গোয়াসপুর), শওকত আলী (চৌঘরী), হাবিবুর রহমান (সিরাই মিয়া, রায়গড়), আব্দুল মুকিত ৯ মেম্বার, একাডুমা), মো: আব্দুল শহীদ, মাশুক উদ্দীন (চৌঘরী), মাহমুদ আলী, চুনু মিয়া (দরজী, চৌঘরী), আব্দুল খালিক (লন্ডনী, গোয়াসপুর), মাওলানা শামছ উদ্দীন (চোঘরী), রিয়াজ উদ্দীন (গোয়াসপুর), ছাদিক আহমদ (চৌঘরী), আব্দুস ছালাম (চৌঘরী), হোসেন আহমদ ( চৌঘরী), মো: মাখন মিয়া (মেম্বার, গোয়াসপুর), আব্দুল ওদুদ (চৌঘরী), ফারুক আহমদ (গোয়াসপুর), ময়না মিয়া ( গোয়াসপুর), ও আছমান উদ্দীন (গোয়াসপুর)। অর্থাৎ সভাপিতিসহ মোট ২৬জন। সভায় আমরা আমাদের পরিকল্পনার কথা অর্থাৎ স্কুল আরম্ভ করার কথাটি এলাকাবাসিকে অবহিত করি। সবাই আমাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ফলে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীগনকে অন্যান্য স্কুলে ভর্তির সুযোগ না দিয়ে অর্থাৎ যাদেরকে একান্তভাবে রাখতে পারা যাবেনা তারা ছাড়া বাকী ছাত্রছাত্রীদেরকে নিয়ে ৬ষ্ঠ এবং আপাতত আগের বছর বা তারও আগে যার্ক নানা অসুবিধার দরুন লেখাপড়া ছেড়া বাড়িতে বসে আছে সেই সকল ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে ৭ম শ্রেণী চালু করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সভায় এলাকা থেকে বাঁশ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে ছাদিক আহমদ, শওকত আলী (চৌঘরী), আব্দুল হেকিম (গোয়াসপুর), মাশুক উদ্দীন (চৌঘরী), ও আবুল কালাম (চৌঘরী) প্রমুখের ওপর।

চলবে……………………

শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার হচ্ছে নিউইয়র্কে

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রথমবারের মত নির্মিত হতে যাচ্ছে স্থায়ী শহীদ মিনার। মহান একুশের ভাষা শহীদদের স্মরণে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া কমিউনিটি কলেজে এ শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন ছিল স্থায়ী শহীদ মিনারের। কিন্তু নানান জটিলতায় সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ হাসান নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির আওতাধীন লাগোর্ডিয়া কমিউনিটি কলেজে দীর্ঘদিন চেষ্টার পর সেখানে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মানে সফল হতে চলেছেন।

জাহিদ হাসান জানান, ইউনেস্কো কর্তৃক ভাষা শহীদদের অবদানের স্বীকৃতির জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রোফাইল তৈরি করি। লাগোর্ডিয়া স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে প্রথমে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু আশা ছাড়িনি।

পরবর্তীকালে ছোট ভাই রায়হান মাহমুদ লাগোর্ডিয়া কলেজ স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের গভর্নর নির্বাচত হলে তার কাছে শহীদ মিনার নির্মাণের গুরুত্ব সম্বলিত সেই প্রোফাইল এবং শহীদ মিনারের নকশা তুলে ধরি। রায়হান মাহমুদ স্টুুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাছে বিলটি নতুন করে প্রস্তাব করেন।

এ প্রসঙ্গে রায়হান মাহমুদ জানান, শহীদ মিনার নির্মাণের বিলটি স্টুডেন্ট গর্ভনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাছে পেশ করার পর ১২ জন গভর্নরের মধ্যে ৮ জন গভর্নর ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানান এবং গত ২৫ জানুয়ারি বিলটি স্টুডেন্ট গভর্নমেন্টে পাস হয়।

স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যে ৮ প্রতিনিধি প্রস্তাবিত বিলে সম্মতি দিয়েছেন, তারা হলেন, ফজলে রাব্বি, শেখ হাফিজ, জয়ি ফার্নান্ডেজ, ইয়ং জো , ইয়ংগরু জিয়াও, জিয়ায়ন লি ও ইয়াইউ ঝাউ ।

এরই মধ্যে শহীদ মিনার স্থাপনের জন্য খরচ বাবদ ৮ হাজার ডলার স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। লাগোর্ডিয়া কমিউনিটি কলেজের ‘ই’ বিল্ডিং এবং ‘এম’ বিল্ডিংয়ের মাঝে খোলা চত্ত্বরে ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থের স্থায়ী শহীদ মিনারটি তৈরি হবে বলে জানা গেছে।