হাফিজুল ইসলাম লস্কর
.
বাঙ্গালী জাতীর আত্বত্যাগের অমরগাথা ডিসেম্বর মাস শুরু। ’৭১-র ডিসেম্বর মাস বাঙালির মহান বিজয় ও শোকের মাস। জাতিকে মেধাহীন ও নেতৃত্বহীন করতে বর্বর পাকিস্থানীদের এদেশীয় দালাল আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের হাতে জীবন দিতে হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানসহ ৩০ লাখ নিরীহ ও মুক্তিযোদ্ধাকে। ১৪ ডিসেম্বর দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে আত্মদানকারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে গিয়ে বিশ্বের কোনো জাতিকে এত রক্ত দিতে হয়নি, এত অগণিত মানুষ ও বুদ্ধিজীবীকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়নি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় তাঁবেদার তথা স্বাধীনতাবিরোধীদের পরিকল্পনা ছিল বাঙালি জাতিকে যে কোনো মূল্যে সুশিক্ষা ও সুযোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত ও মেধাহীন পঙ্গু জাতিতে পরিণত করা ও ধ্বংস করা। এ লক্ষ্যেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের এদেশীয় দালালরা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের বিজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ধরে নিয়ে যায় দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, স্বনামধন্য চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ মেধাবী সাংবাদিক ও মুক্তচিন্তার অধিকারী বুদ্ধিজীবীদের।
৭১’র ১৬ ডিসেম্বর সদ্য বিজয়ী অথচ শোকাহত জাতি হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য স্বজনকে জীবিত খুঁজে পায়নি! জাতি খুঁজে পায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর হাতে নিহত অসংখ্য বুদ্ধিজীবীসহ অগণিত মানুষের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ, কঙ্কাল, মাথার খুলি, যা আজও দেশের বিভিন্ন স্থানে খুঁজে পাওয়া যায়। বহু মুক্তিযোদ্ধা এবং নিরীহ নর-নারী নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের কোনো খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বধ্যভূমিগুলোতে নাম না জানা বহু মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে বহু বছর ধরে। নিশ্চিতভাবেই সেসব বধ্যভূমিতে হারিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীসহ নিরীহ অসংখ্য বাঙালি নর-নারী ও শিশুর মৃতদেহ মিশে একাকার হয়ে গেছে। আমরা স্বভাবতই শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ আত্মদানকারী শহীদদের কাছে ঋণী দেশ ও জাতির গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জনের জন্য। ৭১-এ সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত দেশ ও জাতিকে পরিচালনা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি সুদৃঢ়করণ, সর্বোপরি জাতির সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অপরিহার্য ছিল, যা ৭১’র নরঘাতক তথা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি যথার্থই উপলব্ধি করেছিল। তাই তারা আমাদের বিজয় অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে তাদের নীলনকশা অনুসারে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা অত্যাবশ্যক মনে করেছিল। ঘাতকরা সামান্যতম ছাড় দেয়নি বা কার্পণ্য করেনি পরিকল্পিতভাবে তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে।
প্রতি বছর আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বিজয় দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে থাকি। বিজয় দিবস পালন করতে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিজয় দিবসের মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেও দেশ ও জাতির জন্য আত্মদানকারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের কথা আমরা বেমালুম ভুলে গিয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত না করে দেশের সর্বত্র অফিস-আদালত, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ, দোকানপাট, বাস-ট্রাক, মাইক্রোবাস-কার, লঞ্চ-স্টিমার, ট্রেনসহ সব যানবাহনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে শুরু করি। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি অফিস-আদালত, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, সব সেনানিবাস, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সব সিটি করপোরেশন-পৌরসভাসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোয় ব্যাপক আলোকসজ্জা শুরু করি। খুবই পরিতাপ ও বেদনার সঙ্গে আমরা লক্ষ করি যে, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেও এই আলোকসজ্জা অব্যাহত থাকে, যা ৭১’র ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিদেহী আত্মার প্রতি চরম অবমাননা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন যেমন অপরিহার্য, যা ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়, তেমনি মাসব্যাপী বিভিন্ন স্থাপনায় আলোকসজ্জা প্রদর্শন নিয়মে পরিণত হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে অন্তত ওইদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং আলোকসজ্জা প্রদর্শন বন্ধ রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনামা বা প্রজ্ঞাপন জারি অত্যাবশ্যক। এই স্পর্শকাতর ও জরুরি বিষয় কোনো ক্রমেই সরকারের এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ অম্লান রাখার লক্ষ্যে তাদের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, স্থলবন্দর, শহর-জনপথ, গ্রামগঞ্জের নামকরণের মাধ্যমে আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি অনন্তকাল স্মরণীয় করে রাখাতে পারি। বাঙালি জাতির কাংখিত বিজয় নিশ্চিত করতে বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা আত্মাহুতি দিয়েছেন, যাদের মহান বীরত্বগাথা অবিস্মরণীয় করে রাখা অপরিহার্য। যা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী অকুতোভয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পাশাপাশি তাদের মহান বীরত্বগাথা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির কল্যাণে নিয়োজিত হবে এবং দেশের সংকটময় মুহূর্তে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবে। এভাবে বর্তমান শতাব্দী থেকে আগামী শতাব্দীর মানুষ তথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বংশপরম্পরায় বাঙালি জাতি তার আত্মপরিচয় খুঁজে পাবে। একটি জাতি তার ইতিহাস থেকে শিক্ষা লাভ করে এবং গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের ইতিহাস সে জাতির অহঙ্কার। সেই বিজয়ের ইতিহাসের পথ ধরে জাতি অগ্রসর হবে, অজানা-অচেনাকে জয় করবে। বিজয়ের অবিস্মরণীয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ন্যায়ের পথ ধরে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, প্রতিবাদী হতে শিক্ষা নিয়ে জাতি যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে আত্মনিয়োগ করবে, সর্বোপরি চরম ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবে। মহান বিজয়ের মাস, বিজয় দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অঙ্গীকার হোক অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অবশিষ্ট বধ্যভূমিগুলো আবিষ্কার করে সেগুলোর খনন কাজ সম্পন্ন করার, যা বর্তমান সরকারের আমলে সম্পন্ন না হলে ভবিষ্যতে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বাধ্যতামুলক করাসহ দেশব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জয়গান হোক, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অনাচার ও সন্ত্রাসমুক্ত, জঙ্গিবাদমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন জাতি
হিসেবে বাঙালি বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বিজয়ের মাসের অঙ্গীকার হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অবিচল থাকার, সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের রক্তঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন তথা শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণে ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণের।
সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬
সম্পাদকীয় _______________________________ ডিসেম্বর বিজয় ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মাস
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)