শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬

একনজরে আওয়ামী লীগের ৫৭ বছরের ইতিহাসে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ

হাফিজুল ইসলাম লস্কর :: গত ২২-২৩ অক্টোবর ২০১৬, রোজ রোববার ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন ওবায়দুল কাদের। একনজরে আওয়ামী লীগের ৫৭ বছরের ইতিহাসে যারা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রথম সম্মেলন : ২৩-২৪ জুন ১৯৪৯। সাধারণ সম্পাদক : শামসুল হক।
দ্বিতীয় সম্মেলন : ১৪-১৬ নভেম্বর ১৯৫৩। সাধারণ সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান।
তৃতীয় সম্মেলন : ২১-২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫। সাধারণ সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান।
চতুর্থ সম্মেলন : ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭। সাধারণ সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান।
বিশেষ সম্মেলন : ১৩-১৪ জুন ১৯৫৭। সাধারণ সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান।
পঞ্চম সম্মেলন : ৬-৮ মার্চ সাধারণ সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান।
ষষ্ঠ সম্মেলন : ১৮-২০ মার্চ, ১৯৬৬। সাধারণ সম্পাদক : তাজউদ্দীন আহমদ।
সপ্তম সম্মেলন : ১৯ আগস্ট, ১৯৬৭। সাধারণ সম্পাদক : তাজউদ্দীন আহমদ।
অষ্টম সম্মেলন : ৪ জুন, সাধারণ সম্পাদক : তাজউদ্দীন আহমদ।
নবম সম্মেলন : ৭-৮ এপ্রিল, ১৯৭২।সাধারণ সম্পাদক : জিল্লুর রহমান।
দশম সম্মেলন: ১৮-২০ জানুয়ারি, ১৯৭৪। সাধারণ সম্পাদক : জিল্লুর রহমান।
১১তম সম্মেলন : ৩-৪ এপ্রিল, ১৯৭৭। আহ্বায়ক : সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন।
এর আগে ১৯৭৬ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দায়িত্ব পালন করেন।
১২তম সম্মেলন : ৩-৫ মার্চ, ১৯৭৮। সাধারণ সম্পাদক : আবদুর রাজ্জাক।
১৩তম সম্মেলন : ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১। সাধারণ সম্পাদক : আবদুর রাজ্জাক। আব্দুর রাজ্জাক বহিষ্কৃত হলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন।
১৪তম সম্মেলন : ১-৩ জানুয়ারি, ১৯৮৭। সাধারণ সম্পাদক : সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
১৫তম সম্মেলন : ১৯-২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২। সাধারণ সম্পাদক : জিল্লুর রহমান।
১৬তম সম্মেলন : ৬-৭ মে, ১৯৯৭। সাধারণ সম্পাদক : জিল্লুর রহমান।
১৭তম সম্মেলন : ২৬ ডিসেম্বর, ২০০২। সাধারণ সম্পাদক : আবদুল জলিল।
১৮তম সম্মেলন : ২৪ জুলাই ২০০৯। সাধারণ সম্পাদক : সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
১৯তম সম্মেলন : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২। সাধারণ সম্পাদক : সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
২০তম সম্মেলন : ২২-২৩ অক্টোবর ২০১৬ । সাধারণ সম্পাদক : ওবায়দুল কাদের।

একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন

ছাদিক আহমদ
.
১৯৮১সালে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রার্থমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন রিয়াজ উদ্দীন। তখন বিদ্যালয়ে শিক্ষক সমস্যা প্রকট। তাই প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীন, ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও আমাকে(ছাদিক আহমদ) অর্থাৎ আমরা তিন বন্ধুকে উক্ত বিদ্যালয়ে অবৈতনিক ভাবে শিক্ষকতা করার অনুরোধ জানালে আমরা রাজী হয়ে বিদ্যালয়ে যোগদান করি। এই সময় বিশেষ করে আমার বন্ধু হোসেন আহমদের প্রচেষ্টায় স্কুলে পর পর দুইটি বৃত্তি আসে। এরই ফাকে ফাকে আমরা বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদেরকে প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা সংগ্রহ করে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের জন্য একটি হাতল চেয়ার ও মেয়েদের জন্য একটি পাকা প্রশ্রাবখানা তৈরি করে দিই। ১৯৮৩ সালে আমি বিদেশ চলে যাই এবং ১৯৮৬ সালের ১০ডিসেম্বর আমার আব্বার অসুস্থতার খবর পেয়ে আবার দেশে আসি। তখন হোসেন আহমদ, ফারুক আহমদ ও আমার শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীনের সাথে দেখা করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে বলি যে, বিদেশ থাকতে আমি একদিন স্বপ্নে দেখেছি এলাকায় একটি হাই স্কুল হয়েছে এবং সে স্কুলে আমি শিক্ষকতা করছি। সম্ভবত এ কথা শুনে রিয়াজ উদ্দীন বলেন, "তোমরা যদি আমাকে সাহায্য করো তাহলে এ বছরই আমি ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী চালু করবো। তখন লন্ডন-প্রবাসী আব্দুল খালিক সাহেব ও দেশে এসেছেন। তাই উনার সাথে আলোচনা করে আমাদের সিন্ধান্তের কথা জানাবো বলে স্থির করি। ঐ রাতে ফারুক আহমদ ও হোসেন আহমদ জনাব আব্দুল খালিক সাহেবের সাথে আলাপ করেন এবং পরের দিন আমরা পাচঁজন অর্থাৎ রিয়াজ উদ্দীন, আব্দুল খালিক (লন্ডনী প্রবাসী), ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও আমি মিলে পরামর্শ করে ১৯৮৬ সালের ২১ অথবা ২২ ডিসেম্বর অভিভাবক ও এলাকা বাসীকে নিয়ে একটি সভার আয়োজন করত: সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আইডিএ কক্ষে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণী চালু করে শিক্ষাদান কার্যের সূচনা করি। এ সময় হাজী আব্দুল মনাফ ও হাজী নিসার আলীর সভাপতিত্বে বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা গুলিকে সাফল্যমন্ডিত করতে বিশেষ ভুমিকা রাখেন আব্দুল হেকিম, শওকত আলী, মাশুক উদ্দীন ও আবুল কালাম। পরে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আইডিএ কক্ষের পশ্চিম পাশে ৭ম শ্রেণীর জন্য বাঁশবেত দিয়ে টিনসেডের একটি কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় রিয়াজ উদ্দীন চেয়ার টেবিল, ডেক্স-বেঞ্চ ইত্যাদি যাবতীয় জিনিষ পত্র দিয়ে সহযোগিতা করেন। তখন আমাদের সাথে পর্যায় ক্রমে শিক্ষকতায় যোগদান করেন: আছমান উদ্দীন, বদর উদ্দীন আহমদ (টুনু), মাওলানা আব্দুল লতিফ, হেলাল উদ্দীন আহমদ, আব্দুল মুকিত ও রফিক উদ্দীন (আনা মিয়া) প্রমুখ। প্রথম থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তি ও এলাকার ছাত্রছাত্রীদেরকে এম সি একাডেমি থেকে সার্টিফিকেটসহ নিয়ে আসার দায়িত্ব দেয়া হয় ফারুক আহমদকে। পরবর্তী কালে ফারুক আহমদ জনাব আব্দুল মুকিত সাহেবকে প্রাধান শিক্ষক হওয়ার জন্য তিনির বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করে বিদ্যালয়ের দায়িত্বে নিয়ে আসেন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দ্বিতীয় নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে আব্দুল খালিক (লন্ডনী) সাহেব হোসেন আহমদের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু হোসেন আহমদ তাতে অপারাগতা প্রকাশ করায় আমাদের সকলের আলোচনা সাপেক্ষে পরে তারা মিয়ার প্রস্তাবে এবং হোসেন আহমদের সমর্থনে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া)। পরে পরিচালনা কমিটি আব্দুল মুকিত সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে। প্রায় দুই বছর তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রথমে বিদ্যালয়টির নাম ছিল "রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়"। পরে একটি সভায় মুবিন আহমদ জায়গীরদার (রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়) নামটির সাথে আদর্শ শব্দটি যোগ করার প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এক সময় আব্দুল খালিক (লন্ডনী) সাহেবের দান করা জমিতে বাঁশবেত দিয়ে স্কুল তৈরীর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে বাঁশবেত সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল হেকিম, শওকত আলী, মাশুক উদ্দীন, আবুল কালাম ও আমাকে। ঘরের টিন দান করেন হোসেন আহমদ, মাখন মিয়া ও তমজ্জুল আলী (তুতা মিয়া)। মিস্তরীর মজুরীর আটশত টাকা পড়ে আমার ভাগে। আব্দুল ওদুদ ও জিয়া উদ্দীন অন্যান্য কাজের দায়িত্বে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। এরপর কোনও এক সভায় খয়ের উদ্দীন আহমদের (চুনু মিয়া) সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সিমেন্ট দানের আশ্বাসের পরিপেক্ষিতে বাঁশবেত দিয়ে স্কুল ঘরটি তৈরীর পরিবর্তে পরিকল্পিত ভাবে পাকা করে তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঘর তৈরীতে বালু দান করেন রিয়াজ উদ্দীন। আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করেন তমজ্জুল আলী (তুতা মিয়া) এবং আরেক খন্ড জমি দান করেন মাওলানা আব্দুল হক। পরবর্তীতে আব্দুল মজিদ লস্কর (ময়না মিয়া) তার নামে একখানা বড় হল (নির্মাণ) করে দেন। পাকাঘর তৈরীর অর্থাৎ স্কুলের প্রথম সাময়িক পরিক্ষার পর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদেরকে বর্তমান বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এলাকাবাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। তবে বিদ্যালয়টির উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), তমজ্জুল আলী (তুতা মিয়া), মাখন মিয়া, আলা উদ্দীন, আব্দুল ওদুদ, আব্দুল খালিক (লন্ডনী), জিয়া উদ্দীন, ইসমাইল আলী, তারা মিয়া, মাওলানা শওকত আলী, হেলাল উদ্দীন আহমদ, আব্দুল আজিজ, রিয়াজ উদ্দীন, হোসেন, প্রমুখ। পরবর্তী কালে হোসেন আহমদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রায় ত্রিশটিরও অধিক ফ্যান স্কুলে লাগানো হয়। বিদ্যালয়ের প্রথম লাইব্রেরীটি স্থাপিত হয় ফারুক আহমদের ব্যক্তিগত সংগৃহিত বইগুলি দিয়ে। শিক্ষকদের মধ্যে ফারুক আহমদ ও হেলাল উদ্দীন আহমদ বর্তমানে লন্ডনে। তারা প্রথম স্কুল পরিচালনা কমিটির মেম্বারও ছিলেন। হোসেন আহমদ ও বদর উদ্দীন আহমদ (টুনু) বর্তমানে ব্যবসা করছেন। আছমান উদ্দীন সৌদি আরবে, রফিক উদ্দীন আহমদ (আনা মিয়া) স্বেচ্ছায় বিদ্যালয় থেকে অব্যহতি নিয়ে দেশেই আছেন। শুধু আমি ও জনাব আব্দুল মুকিত এখনও শিক্ষকতা পেশায় আছি। বিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের হ্রদয়ের টান এখনও আমাদের টিকেয়ে রেখেছে। এই বিদ্যালয়ের সাথে যাদের গভীর সম্পর্ক ও অবদান ছিল তাদের কেউ কেউ আজ হয়তো আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাদের অবদান আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ছাদিক আহমদ: অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। (রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, স্বারক গ্রন্থ: ২০০৬ থেকে সংগৃহিত) সংগ্রহে: হাফিজুল ইসলাম লস্কর।

মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৬

রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আমার স্মৃতিময় কিছু কথা

(প্রয়াত অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) আব্দুল খালিক
.
রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে লেখার আগে আমাকে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলতে হচ্ছে। তা হলো, আমি যুক্ত রাজ্যে যাওয়ার পরে সেখানকার সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু কিছু জানার ও বুঝার চেষ্টা করি। এক সময় কাজের জায়গায় জনৈক ইহুদী সহকর্মীর সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে এবং তার কাছ থেকেই আমি ইসরাইলের একটি কম্যুনিটি সংগঠন কিবুটস (Kibbutz) সম্পর্কে বিস্তারিত শুনি। অর্থাৎ কিভাবে এ সংগঠনটি সমবায়ের মাধ্যমে গরীব ইহুদীদের পুনর্বাসন, ব্যবসা ও কর্ম সংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। কিভাবে ইয়াং ইহুদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ
থেকে ছুটি কাটাতে ইসরাইলে গিয়ে সংগঠনটিকে সাহায্য সহযোগিতা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন থেকেই আমার মনে প্রেরণা জাগে কীভাবে আমার এলাকায় এরকম একটি সংগঠন গড়ে তোলা যায়, এলাকার উন্নয়ন করা যায়। পরবর্তীকালে যখনই দেশে এসেছি বিষয়টি নিয়ে আমি গ্রামবাসি বিভিন্ন ঘনিষ্ঠ জনের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছি। কিন্তু তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। ১৯৭৯ সালে সপরিবারে দেশে আসার পর আমি আমার মেয়ে মনোয়ারা বেগমকে "চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে" ভর্তি করি। তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে হুসেন আহমদ ও ফারুক আহমদ উক্ত বিদ্যালয়ে অবৈতনিক ভাবে শিক্ষকতা করছেন। এ সুবাদে তাদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মে ও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারি এরাও এলাকার উন্নয়নের জন্য একটা কিছু করতে চান। এই দু'জন তরুনের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও ধ্যান-ধারণা তখন আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন আমি কিবুটস এর মতো একটি সমবায় সমিতি গঠনের জন্য তাদের সহযোগিতায় এলাকাবাসিকে নিয়ে একটি সভা আহবান করি। কিন্তু নানা কারনে তা ব্যর্থ হয়। পরে ১৯৮৪ সালের দিকে আবার আমি দেশে আসার পরে আমরা একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাই। তখন আমাদের সাথে রিয়াজ উদ্দীন, ছালিক আহমদ প্রমুখ জড়িয়ে গেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ভূমির অভাবে ও আর্থিক সহায়তা লাভে ব্যর্থ হওয়ায় এই পরিকল্পনাটিও সভা আহবান এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যেই থেকে যায়। পরিবর্তীকালে এ বিষয়ে "কালিদাসপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে"মতিউর রহমান, আলাউদ্দীন ও রজই মিয়া প্রমুখের ডাকে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমি ও ফারুক আহমদ এক সাথে সভায় অংশগ্রহন করেছি অর্থাৎ আমি তাকে সভায় নিয়ে গেছি কিন্তু স্কুলের একটি গ্রহনযোগ্য স্থান নির্ধারনে আমরা ব্যর্থ হই। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি আবার দেশে আসি। যেদিন আসি ঐদিনই রাতে আমার দেশে আসার খবর পেয়ে ফারুক আহমদ আমার বাড়ীতে আসেন। কুশল বিনিময়ের পর আমাকে জানান যে, আমার অনু পস্থিতিতে তারা বার বার চেষ্টা করেও একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে, কিভাবে এলাকাবাসি "রায়গড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে" উদ্যোগ নেন এবং সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতায় তার ভুমিকা কি ছিল ইত্যাদি। কথাগুলো বলার পর ফারুক আমাকে বলেন যে, এ বছর বলিষ্ট উদ্যোগ নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আর কোনও দিনই স্কুল করা সম্ভব হবেনা। কারণ আমাদের দুর্বলতার সুযোগে হয়তো অন্য স্থানে স্কুলটি হয়ে যাবে। তাই চুড়ান্ত ফয়সালার জন্য তারা আমার দেশে আসার অপেক্ষা করছেন। ঐ দিন সম্ভবত রাত ৭টা থেকে ১১-১২টা পর্যন্ত ফারুক আহমদের সাথে এ নিয়ে আমার আলাপ-আলোচনা চলে। ফারুক আহমদ আমাকে বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, আমি জমি দান করিলেই স্কুলটি হয়ে যাবে। তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। দীর্ঘ জার্নি করে এসেছি, ঘুম হয়নি বিধায় ক্লান্ত শরীর। কিন্তু সেদিন একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে আমি এতই বিভোর ছিলাম যে, খাওয়া দাওয়া বা বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করিনি। তেমনি ফারুক আহমদও এমন নাছোড়-বান্দা। সে আমার কাছ থেকে জমিদানের প্রতিশ্রুতি আদায় না করে যেন বসা থেকে ওঠবে না। আমিও ভাবলাম একটা স্কুল হোক। তাই তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম,তোমরা স্কুল আরম্ভ করো, আমি যে ভাবেই হোক জমি দেবো। পরের দিন ফারুক আহমদ, হুসেন আহমদ, রিয়াজ উদ্দীন, ছাদিক আহমদ ও আমি "চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে'' এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে কিভাবে স্কুলটি আরম্ভ করা যায় এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটি সভা আহবান করি। হাজি আব্দুল মনাফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অনেক জনসমাবেশ হয়। সভায় আমরা উক্ত প্রাইমারী স্কুলের পাশে অস্থায়ীভাবে একটি টিনসেডের ঘর বানিয়ে আপাতত স্কুলের ক্লাস আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেই। তখন এলাকা থেকে স্কুলঘর বানানোর জন্য বাঁশ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল হেকিম, মাশুক উদ্দীন, শওকত আলী, আবুল কালাম ও দুদু মিয়া প্রমুখকে। এই সভায় আরও সিন্ধান্ত নেয়া হয় যে, ডিসেম্বর মাসের শেষ সাপ্তাহে সম্ভবত স্কুলের ফলাফল প্রকাশের দিন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে ফলাফল প্রকাশের পর পরই ছাত্রছাত্রীগন সার্টিফিকেট নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হবার আগেই আমাদের কে দ্রুত স্কুল আরম্ভ করতে হবে। নতুবা ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না। ফলাফল প্রকাশের দিন অনুষ্টিত সভায় সম্ভবত আবারও হাজী আব্দুল মনাফ সভাপতিত্ব করেন। এতে স্কুলের জন্য টিন দান করেন হুসেন আহমদ, মাখন মিয়া ও তজম্মুল আলী(তুতামিয়া) প্রমুখ। স্কুলের জন্য ব্যনারের কাপড় ও প্রয়োজনীয় খাতাপত্র দানের প্রতিশ্রুতি দেন আব্দুল ওদুদ। এছাড়াও দু-একজন আর্থিকভাবে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ও দেন। সভায় ফারুক আহমদকে প্রধান শিক্ষক, হুসেন আহমদকে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং আছমান উদ্দীন ও ছাদিক আহমদকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে জানুয়ারী মাসের পহেলা তারিখ থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যথাসময়ে ৩/৪জন ছাত্রছাত্রীও স্কুলে ভর্তি হন। প্রাইমারী স্কুলে তাদের ক্লাস আরম্ভ হয়। এ ব্যপারে প্রসংশনীয় ভুমিকা পালন করেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীন। সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় সগৌরবে আরম্ভ হয় "রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা" পরে এ নামটির সাথে আদর্শ শব্দটি যোগ করে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় "রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়" জানুয়ারী মাসের মধ্যভাগে অথবা শেষ দিকে আমার ওপর জমি দানের জন্য চাপ আসে। আমিও আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলের ঠিক দক্ষিক পাশের জমিটি দান করি। কিন্তু বাঁধ সাধেন আমার অংশীদারগন বিধায় আমাকে বর্তমান হাই স্কুলের দক্ষিন-পূর্ব কোনের জমিটি দান করতে হয়। ফলে স্কুল প্রতিষ্ঠায় দোদুল্যমান পরিস্থিতি বা আর কোন বাধা রইলো না। এই সময় প্রয়োজন দেখা দেয় একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের। তখন ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও ছাদিক আহমদের কাছ থেকে খবর পাই তাদের শিক্ষক আব্দুল মুকিত সাহেব বিদেশ থেকে দেশে এসে রণকেলী "গোলাপ কুঁড়ি শিশু বিদ্যালয়ে" কর্মরত। তাই আমরা ফারুক আহমদ ও হোসেন আহমদকে দায়িত্ব দেই উনাকে আমাদের স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়ে আসার জন্য আলাপ করতে। সম্ভবত জানুয়ারী মাসের শেষ অথবা ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে তারা আব্দুল মুকিত সাহেবকে শিক্ষকতায় আসতে রাজী করান। পরবর্তী কোনও একটি সভায় ফারুক আহমদ প্রস্তাব করেন যে, আব্দুল মুকিত সাহেব তার শিক্ষক, তাই তিনি প্রধান শিক্ষকের পদটি মুকিত সাহেবকে ছেড়ে দিতে চান। ফারুক আহমদ আরো বলেন যে, তিনি মুকিত সাহেবকে কথা দিয়ে এসেছেন, তাই পদটি মুকিত সাহেবকে না দিলে তিনি শিক্ষকতায় নাও আসতে পারেন। কেউ কেউ তার এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেও শেষে আমরা রাজী হয়ে যাই। পরে তাঁর সাথে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রফিক উদ্দীন (আনা মিয়া) ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭ আমার দান করা ভূমিতে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের দিন ধার্য করা হয়। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় স্কুলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল হক (তানু মিয়া)। স্কুলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ফারুক আহমদ এবং এলাকাবাসীর পক্ষে আলা উদ্দীন ও শেখ আব্দুল মতিন (পাখি মিয়া)। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন মসরুছুল করিম চৌধুরী, থানা শিক্ষা অফিসার ও থানা নির্বাহী অফিসার এবং সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাদেক আহমদ চৌধুরী। সভা শেষে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্কুলের ক্লাস উদ্ভোধন করেন মসরুছুল করিম চৌধুরী। ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্য ভাগে খয়ের উদ্দীন আহমদের (চুনুমিয়া) প্রস্তাবে আমার দান করা ভূমিতে ইত:পুর্বে সিদ্ধান্ত নেয়া টিনসেডের ঘরের পরিবর্তে পাকা দালান নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ ব্যাপারে খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), তজম্মুল আলী (তুতা মিয়া) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৭ এর ৭ এপ্রিল আমার বিলাত যাওয়ার আগে খয়ের উদ্দীন আহমদের (চুনু মিয়া) প্রশংসনীয় কর্মতৎপরতার জন্য তাকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর পরে স্কুলের একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে আমি আমার সাধ্যমত পৃষ্টপোষকতা করে গেছি। বিদ্যালয়টি এলাকাবাসী সকলের প্রচেষ্টা ও আন্তরিক সহযোগিতায় আপন গতিতে তার অভিষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে গেছে। এই এগিয়ে যাবার পথে যারা সার্বিকভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তারা হলেন : আলা উদ্দীন, হাজী নিসার আলী, হাজী আব্দুল মনাফ, খোন্দকার ফখর উদ্দীন, জয়াইদ আলী, হাজী তেরা মিয়া, ইসমাঈল আলী, হোসেন আহমদ, ফারুক আহমদ, ছাদিক আহমদ, আছমান উদ্দীন, হেলাল উদ্দীন আহমদ (মেম্বার), আব্দুল ওদুদ, রিয়াজ উদ্দীন, মাখন মিয়া, জিয়া উদ্দীন, আব্দুল মজিদ (ময়না মিয়া), বদর উদ্দীন আহমদ (টুনু মিয়া), মাওলানা শওকত আলী, খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), হাজী আব্দুল আজিজ (ড্রাইভার), তজম্মুল আলী (তুতা মিয়া), আরব আলী, কুটু মিয়া, আব্দুল মুকিত, মাওলানা আব্দুল লতিফ, জামাল উদ্দীন ও রফিক উদ্দীন (আনা মিয়া) প্রমুখ।
____________এম.এ খালিক : অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।(সংগৃহিত)[সংগ্রহে:: হাফিজুল ইসলাম লস্কর]

রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আমার স্মৃতিময় কিছু কথা(প্রয়াত অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) আব্দুল খালিক

রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে লেখার আগে আমাকে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলতে হচ্ছে। তা হলো, আমি যুক্ত রাজ্যে যাওয়ার পরে সেখানকার সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু কিছু জানার ও বুঝার চেষ্টা করি। এক সময় কাজের জায়গায় জনৈক ইহুদী সহকর্মীর সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে এবং তার কাছ থেকেই আমি ইসরাইলের একটি কম্যুনিটি সংগঠন কিবুটস (Kibbutz) সম্পর্কে বিস্তারিত শুনি। অর্থাৎ কিভাবে এ সংগঠনটি সমবায়ের মাধ্যমে গরীব ইহুদীদের পুনর্বাসন, ব্যবসা ও কর্ম সংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। কিভাবে ইয়াং ইহুদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটি কাটাতে ইসরাইলে গিয়ে সংগঠনটিকে সাহায্য সহযোগিতা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন থেকেই আমার মনে প্রেরণা জাগে কীভাবে আমার এলাকায় এরকম একটি সংগঠন গড়ে তোলা যায়, এলাকার উন্নয়ন করা যায়। পরবর্তীকালে যখনই দেশে এসেছি বিষয়টি নিয়ে আমি গ্রামবাসি বিভিন্ন ঘনিষ্ঠ জনের সাথে আলাপ আলোচনা করেছি। কিন্তু তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। ১৯৭৯ সালে সপরিবারে দেশে আসার পর আমি আমার মেয়ে মনোয়ারা বেগমকে "চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে" ভর্তি করি। তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে হুসেন আহমদ ও ফারুক আহমদ উক্ত বিদ্যালয়ে অবৈতনিক ভাবে শিক্ষকতা করছেন। এ সুবাদে তাদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মে ও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারি এরাও এলাকার উন্নয়নের জন্য একটা কিছু করতে চান। এই দু'জন তরুনের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও ধ্যান-ধারণা তখন আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন আমি কিবুটস এর মতো একটি সমবায় সমিতি গঠনের জন্য তাদের সহযোগিতায় এলাকাবাসিকে নিয়ে একটি সভা আহবান করি। কিন্তু নানা কারনে তা ব্যর্থ হয়। পরে ১৯৮৪ সালের দিকে আবার আমি দেশে আসার পরে আমরা একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাই। তখন আমাদের সাথে রিয়াজ উদ্দীন, ছালিক আহমদ প্রমুখ জড়িয়ে গেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ভূমির অভাবে ও আর্থিক সহায়তা লাভে ব্যর্থ হওয়ায় এই পরিকল্পনাটিও সভা আহবান এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যেই থেকে যায়। পরিবর্তী কালে এ বিষয়ে "কালিদাসপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে"মতিউর রহমান, আলাউদ্দীন ও রজই মিয়া প্রমুখের ডাকে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমি ও ফারুক আহমদ এক সাথে সভায় অংশগ্রহন করেছি অর্থাৎ আমি তাকে সভায় নিয়ে গেছি কিন্তু স্কুলের একটি গ্রহনযোগ্য স্থান নির্ধারনে আমরা ব্যর্থ হই। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি আবার দেশে আসি। যেদিন আসি ঐদিনই রাতে আমার দেশে আসার খবর পেয়ে ফারুক আহমদ আমার বাড়ীতে আসেন। কুশল বিনিময়ের পর আমাকে জানান যে, আমার অনু পস্থিতিতে তারা বার বার চেষ্টা করেও একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে, কিভাবে এলাকাবাসি "রায়গড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে" উদ্যোগ নেন এবং সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতায় তার ভুমিকা কি ছিল ইত্যাদি। কথাগুলো বলার পর ফারুক আমাকে বলেন যে, এ বছর বলিষ্ট উদ্যোগ নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আর কোনও দিনই স্কুল করা সম্ভব হবেনা। কারণ আমাদের দুর্বলতার সুযোগে হয়তো অন্য স্থানে স্কুলটি হয়ে যাবে। তাই চুড়ান্ত ফয়সালার জন্য তারা আমার দেশে আসার অপেক্ষা করছেন। ঐ দিন সম্ভবত রাত ৭টা থেকে ১১-১২টা পর্যন্ত ফারুক আহমদের সাথে এ নিয়ে আমার আলাপ-আলোচনা চলে। ফারুক আহমদ আমাকে বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, আমি জমি দান করিলেই স্কুলটি হয়ে যাবে। তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। দীর্ঘ জার্নি করে এসেছি, ঘুম হয়নি বিধায় ক্লান্ত শরীর। কিন্তু সেদিন একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে আমি এতই বিভোর ছিলাম যে, খাওয়া দাওয়া বা বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করিনি। তেমনি ফারুক আহমদও এমন নাছোড়-বান্দা। সে আমার কাছ থেকে জমিদানের প্রতিশ্রুতি আদায় না করে যেন বসা থেকে ওঠবে না। আমিও ভাবলাম একটা স্কুল হোক। তাই তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম,তোমরা স্কুল আরম্ভ করো, আমি যে ভাবেই হোক জমি দেবো। পরের দিন ফারুক আহমদ, হুসেন আহমদ, রিয়াজ উদ্দীন, ছাদিক আহমদ ও আমি "চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে'' এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে কিভাবে স্কুলটি আরম্ভ করা যায় এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটি সভা আহবান করি। হাজি আব্দুল মনাফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অনেক জনসমাবেশ হয়। সভায় আমরা উক্ত প্রাইমারী স্কুলের পাশে অস্থায়ীভাবে একটি টিনসেডের ঘর বানিয়ে আপাতত স্কুলের ক্লাস আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেই। তখন এলাকা থেকে স্কুলঘর বানানোর জন্য বাঁশ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল হেকিম, মাশুক উদ্দীন, শওকত আলী, আবুল কালাম ও দুদু মিয়া প্রমুখকে। এই সভায় আরও সিন্ধান্ত নেয়া হয় যে, ডিসেম্বর মাসের শেষ সাপ্তাহে সম্ভবত স্কুলের ফলাফল প্রকাশের দিন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে ফলাফল প্রকাশের পর পরই ছাত্রছাত্রীগন সার্টিফিকেট নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হবার আগেই আমাদের কে দ্রুত স্কুল আরম্ভ করতে হবে। নতুবা ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না। ফলাফল প্রকাশের দিন অনুষ্টিত সভায় সম্ভবত আবারও হাজী আব্দুল মনাফ সভাপতিত্ব করেন। এতে স্কুলের জন্য টিন দান করেন হুসেন আহমদ, মাখন মিয়া ও তজম্মুল আলী(তুতামিয়া) প্রমুখ। স্কুলের জন্য ব্যনারের কাপড় ও প্রয়োজনীয় খাতাপত্র দানের প্রতিশ্রুতি দেন আব্দুল ওদুদ। এছাড়াও দু-একজন আর্থিকভাবে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ও দেন। সভায় ফারুক আহমদকে প্রধান শিক্ষক, হুসেন আহমদকে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং আছমান উদ্দীন ও ছাদিক আহমদকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে জানুয়ারী মাসের পহেলা তারিখ থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যথাসময়ে ৩/৪জন ছাত্রছাত্রীও স্কুলে ভর্তি হন। প্রাইমারী স্কুলে তাদের ক্লাস আরম্ভ হয়। এ ব্যপারে প্রসংশনীয় ভুমিকা পালন করেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীন। সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় সগৌরবে আরম্ভ হয় "রাণাপিং উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা" পরে এ নামটির সাথে আদর্শ শব্দটি যোগ করে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় "রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়" জানুয়ারী মাসের মধ্যভাগে অথবা শেষ দিকে আমার ওপর জমি দানের জন্য চাপ আসে। আমিও আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলের ঠিক দক্ষিক পাশের জমিটি দান করি। কিন্তু বাঁধ সাধেন আমার অংশীদারগন বিধায় আমাকে বর্তমান হাই স্কুলের দক্ষিন-পূর্ব কোনের জমিটি দান করতে হয়। ফলে স্কুল প্রতিষ্ঠায় দোদুল্যমান পরিস্থিতি বা আর কোন বাধা রইলো না। এই সময় প্রয়োজন দেখা দেয় একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের। তখন ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও ছাদিক আহমদের কাছ থেকে খবর পাই তাদের শিক্ষক আব্দুল মুকিত সাহেব বিদেশ থেকে দেশে এসে রণকেলী "গোলাপ কুঁড়ি শিশু বিদ্যালয়ে" কর্মরত। তাই আমরা ফারুক আহমদ ও হোসেন আহমদকে দায়িত্ব দেই উনাকে আমাদের স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়ে আসার জন্য আলাপ করতে। সম্ভবত জানুয়ারী মাসের শেষ অথবা ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে তারা আব্দুল মুকিত সাহেবকে শিক্ষকতায় আসতে রাজী করান। পরবর্তী কোনও একটি সভায় ফারুক আহমদ প্রস্তাব করেন যে, আব্দুল মুকিত সাহেব তার শিক্ষক, তাই তিনি প্রধান শিক্ষকের পদটি মুকিত সাহেবকে ছেড়ে দিতে চান। ফারুক আহমদ আরো বলেন যে, তিনি মুকিত সাহেবকে কথা দিয়ে এসেছেন, তাই পদটি মুকিত সাহেবকে না দিলে তিনি শিক্ষকতায় নাও আসতে পারেন। কেউ কেউ তার এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেও শেষে আমরা রাজী হয়ে যাই। পরে তাঁর সাথে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রফিক উদ্দীন (আনা মিয়া) ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭ আমার দান করা ভূমিতে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের দিন ধার্য করা হয়। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় স্কুলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল হক (তানু মিয়া)। স্কুলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ফারুক আহমদ এবং এলাকাবাসীর পক্ষে আলা উদ্দীন ও শেখ আব্দুল মতিন (পাখি মিয়া)। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন মসরুছুল করিম চৌধুরী, থানা শিক্ষা অফিসার ও থানা নির্বাহী অফিসার এবং সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাদেক আহমদ চৌধুরী। সভা শেষে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্কুলের ক্লাস উদ্ভোধন করেন মসরুছুল করিম চৌধুরী। ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্য ভাগে খয়ের উদ্দীন আহমদের (চুনুমিয়া) প্রস্তাবে আমার দান করা ভূমিতে ইত:পুর্বে সিদ্ধান্ত নেয়া টিনসেডের ঘরের পরিবর্তে পাকা দালান নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ ব্যাপারে খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), তজম্মুল আলী (তুতা মিয়া) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৭ এর ৭ এপ্রিল আমার বিলাত যাওয়ার আগে খয়ের উদ্দীন আহমদের (চুনু মিয়া) প্রশংসনীয় কর্মতৎপরতার জন্য তাকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর পরে স্কুলের একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে আমি আমার সাধ্যমত পৃষ্টপোষকতা করে গেছি। বিদ্যালয়টি এলাকাবাসী সকলের প্রচেষ্টা ও আন্তরিক সহযোগিতায় আপন গতিতে তার অভিষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে গেছে। এই এগিয়ে যাবার পথে যারা সার্বিকভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তারা হলেন : আলা উদ্দীন, হাজী নিসার আলী, হাজী আব্দুল মনাফ, খোন্দকার ফখর উদ্দীন, জয়াইদ আলী, হাজী তেরা মিয়া, ইসমাঈল আলী, হোসেন আহমদ, ফারুক আহমদ, ছাদিক আহমদ, আছমান উদ্দীন, হেলাল উদ্দীন আহমদ (মেম্বার), আব্দুল ওদুদ, রিয়াজ উদ্দীন, মাখন মিয়া, জিয়া উদ্দীন, আব্দুল মজিদ (ময়না মিয়া), বদর উদ্দীন আহমদ (টুনু মিয়া), মাওলানা শওকত আলী, খয়ের উদ্দীন আহমদ (চুনু মিয়া), হাজী আব্দুল আজিজ (ড্রাইভার), তজম্মুল আলী (তুতা মিয়া), আরব আলী, কুটু মিয়া, আব্দুল মুকিত, মাওলানা আব্দুল লতিফ, জামাল উদ্দীন ও রফিক উদ্দীন (আনা মিয়া) প্রমুখ।
____________এম.এ খালিক : অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।(সংগৃহিত)[সংগ্রহে:: হাফিজুল ইসলাম লস্কর]